ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট বনাম দ্বারকানাথ
জমিদারি পরিচালনায় দ্বারকানাথ ছিলেন সুদক্ষ।দ্বারকানাথের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের লেখক ব্লেয়ার বি ক্লিং লিখেছেন-“To him Zamindari was a business like any other and he insisted on the business-like and efficient management of his estates.” দেওয়ানি আদালতের আইনকানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে কারও পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। দ্বারকানাথের দুই জীবনীকার কিশোরীচাঁদ মিত্র ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথের পৈতৃক জমিদারি কুষ্টিয়ার অন্তর্গত বিরাহিমপুরে সুকৌশলে জমিদারি পরিচালনা প্রসঙ্গে একটি গল্পের অবতারণা করেছেন।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“বিরাহিমপুরের প্রজাগণ বরাবর দুর্বৃত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ- সহজে খাজনা আদায় করিতে চায় না। ইহার অধিকাংশ নিম্নশ্রেণীর মুসলমান। কথায় কথায় জোট বাঁধে এবং জমিদারকে খাজনা হইতে বঞ্চিত করিবার চেষ্টা করে।” এমনি একবার বিরাহিমপুরের দুঁদে-গোছের এক লোকের কাছ থেকে খাজনা আদায় না হওয়ায় জমিদারি থেকে নালিশ রুজু হল প্রজাদের বিরুদ্ধে। প্রজারা একজোট হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে দরখাস্ত পাঠাল সরেজমিনে তদন্ত করতে। ম্যাজিস্ট্রেট সশরীরে এসে গ্রামের মাঝখানে তাঁবু ফেললেন, প্রজাদের দুঃখে সুখে নায়েব গোমস্তার অত্যাচারের কাহিনি শুনে একতরফা রায় দিলেন যে প্রজারা নির্যাতিত এবং জমিদার দোষী। প্রজাদের তো পোয়া বারো, পারলে তারা নায়েব-গোমস্তার নাকের সামনে তুড়ি দিতে চায়। খবর পৌঁছাল দ্বারকানাথের কাছে, কলকাতায়। ভারতবর্ষ সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রত্যক্ষভাবে মহারাণীর অধীনে আসবার পূর্বে অনেক ম্যাজিস্ট্রেটের খুঁজলে নানা দোষ পাওয়া যেত। দ্বারকানাথ এই ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বজীবন অনুসন্ধান করে দেখলেন যে সে ত্রুটিমুক্ত নন। সব তথ্য জোগাড় করে দ্বারকানাথ বিরাহিমপুরে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেটের তাঁবুতে। দ্বারকানাথ ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করলেন রায়তদের বে-আইনি একজোট ভেঙে দিতে, তা না হলে কেবল জমিদারের ক্ষতি হবে না, উপরন্তু ওই অঞ্চলের রায়তদের রক্ষা করার দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। দ্বারকানাথ ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন প্রজাদের নালিশ ভিত্তিহীন এবং জমিদারকে খাজনা আদায়ের অধিকার ফিরিয়ে দিলে ন্যায়বিচারের মর্যাদা রক্ষা পাবে।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“ইহাতেও যখন সাহেব বাহাদুরের দুর্মতি অটুট থাকিল, তখন দ্বারকানাথ ধীরে ধীরে তাঁহাকে পূর্ব্ব জীবনের কথাগুলি স্মরণ করাইয়া দিয়া পুলিশের ডিস্ট্রিক্ট সুপারিটেন্ডেন্টের হস্তে সমর্পণ করিবার ভীতি প্রদর্শন করাতেই সাহেব একেবারে নরম হইয়া গেলেন, জমিদারের সহায়তা করিলেন, শান্তি পুনঃস্থাপিত হইল- বিরাহিমপুর পদাবনত হইল।” দ্বারকানাথের বৈষয়িক বিষয়ে তীক্ষ্ম নজর ছিল। বিষয়কর্মের ব্যাপারে কেউ তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিংবা প্রতারণা করবে- এ তিনি বরখাস্ত করতে পারতেন না। দ্বারকানাথের জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দ্বারকানাথের স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভ প্রসঙ্গে লিখেছেন- “যদি বলা হয় এটা অন্যায়ভাবে ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি- তা হলে মানতেই হবে দ্বারকানাথ এ সবের উর্দ্ধে ছিলেন না। যেমন রাজনীতি অথবা যুদ্ধ-বিদ্রোহের ক্ষেত্রে, তেমনি ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। ছল-বল-কৌশলের সুযোগ নিতে কোনো প্রতিপক্ষ ছাড়ে না।” জমিদারির ক্ষেত্রেও দ্বারকানাথ ছিলেন রণকৌশলী।
দেওয়ান দ্বারকানাথ ও নতুন কালেক্টর
দ্বারকানাথ ছিলেন অবস্থাপন্ন জমিদার, কর্মদক্ষ, স্বাধীনচেতা। দ্বারকানাথ দেওয়ান হয়ে সমস্ত বিভাগটাকে এমন পাকাভাবে ও সুষ্ঠরূপে পরিচালনা করছিলেন যে সাদর বোর্ডের সেক্রেটারি পার্কার সাহেব অশেষ প্রশংসা তো করলেনই, তিনি দ্বারকানাথের চিরন্তন বন্ধু হয়েও দাঁড়ালেন। এই সময়ে দেওয়ান দ্বারকানাথ নিয়ে একটি গল্পের করেছেন অমৃতময় মুখোপাধ্যায়।
একজন নতুন কালেক্টর এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। তাঁর অফিসও ওই বাড়িতেই। ওই বাড়ির দ্বারকানাথের অংশের অফিসে তখন নুনের দাদন দেওয়া হচ্ছে। দেওয়ান দ্বারকানাথের তত্ত্বাবধানে টাকা দিচ্ছেন মদন চাটুজ্জেকে। নুনের দাদন নিতে অনেক চাষাভুষো গোছের লোক এসেছে এবং তারা উচ্চস্বরে চিৎকার করে কথাবার্তা বলছে। কালেক্টর সাহেবের ঘরে তাদের কথাবার্তার আওয়াজ পৌঁছলে তিনি মদন চাটুজ্জকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, “এখানে গোলমাল অসহ্য। বলো বাইরে গাছতলায় বসে দাদন দিতে।”
দ্বারকানাথ অন্যায়ে মুখ বুঁজে সয়ে থাকার লোক নন। তিনিও বলে পাঠালেন-“এ সব টাকাকড়ির ব্যাপার। বোকা লোক ছাড়া টাকা হাতে থাকতে গাছতলায় কেউ বসে না। তোমার যদি গোলমাল সহ্য না হয় তো তুমি গিয়ে গাছতলায় কাছারী করতে পার।”
সহৃদয় দ্বারকানাথ ও গদাধর আচার্য
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র অমৃতময় মুখোপাধ্যায় ২৪ পরগণায় কালেক্টরের অধীনে দ্বারকানাথ যখন সেরেস্তাদারের কাজ করতেন, সেই সময়ে দ্বারকানাথের পরোপকারিতা নিয়ে একটি গল্পের উল্লেখ করেছেন। দ্বারকানাথ প্রথম সেরেস্তাদারিতে বহাল থাকার সময় ভবানীপুরে গদাধর আচার্য বলে একজন কাপড়ের আড়তদার ছিলেন। গদাধর আচার্যের একটি ‘কাপ্তেন অফিস’ ছিল। ছিল সম্ভবত স্টিভেডোরের ব্যবসা। গদাধর দুই দিক সামলাতে না পেরে ভরাডুবি হয় তার। শেষপর্যন্ত ওই কাপ্তানি আফিসের মোকদ্দমায় তার সব সম্পত্তি বাঁধা পড়ে। গদাধর আচার্যের মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী দেনার দায়ে সব সম্পত্তি এমনকী তার বসতবাড়ি পর্যন্ত দ্বারকানাথকে বেচে দেন।
অসহায় ও দুঃখীদের দুরবস্থা দেখে দ্বারকানাথ সবসময়ই ব্যথিত। এক্ষেত্রে মৃত গদাধরের বসতবাড়ি দখল নিতে গিয়ে দেখলেন বিধবার দুরবস্থার শেষ নেই। বিধবার ছোট ছেলেটি কান্নাকাটি করছে। কারণ কে নাকি তাকে বলেছে দ্বারকানাথ তাকে ধরে নিয়ে যাবেন এবং সে আর ওই বাড়িতে ঢুকতে পাবে না। ছেলেটির কান্না দেখে দ্বারকানাথ দুঃখে কাতর হয়ে বিধবাকে ডেকে বসতবাড়ির দলিলটি ফেরত দিয়ে বলে আসেন যে, ওই ছেলে ও মাকে থাকবার জন্য তিনি ওই বাড়ি দিচ্ছেন এবং ছেলে যতদিন না বড় হয় ততদিন ভরনপোষণের ভারও তিনি নিলেন।
ধারাবাহিক লেখার ‘কথকতা’ বিভাগটি এখানেই সমাপ্ত
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৩ এবং পর্ব ৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৫ এবং পর্ব ৬ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৭ এবং পর্ব ৮ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৯ এবং পর্ব ১0 পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১১ এবং পর্ব ১২ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১৩ এবং পর্ব ১৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন।